প্রতি ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার: জরুরি স্বাস্থ্যের এক নতুন দিগন্ত

সম্মান শুধু কথায় নয়, কাজে: নতুন করে ভাবার সময়
নারীর প্রতি সম্মানের ধারণাটি সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়েছে। একসময় সম্মান বলতে কেবল নারীকে ঘরের লক্ষ্মী হিসেবে দেখা বা তাদের প্রতি বিশেষ কিছু প্রথাগত আচরণকে বোঝানো হতো। কিন্তু এই ধারণা এখন যথেষ্ট নয়। প্রকৃত সম্মান মানে:
* মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি: নারীকে শুধুমাত্র লিঙ্গের ভিত্তিতে বিচার না করে, তাদের মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতাকে সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেওয়া। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাঙ্গনে বা সমাজে তাদের অবদানের সঠিক মূল্যায়ন করা।
* অধিকারের প্রতি সংবেদনশীলতা: নারীর ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রতি সংবেদনশীল হওয়া এবং সেগুলোকে সমুন্নত রাখা। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে সম্মান করা।
* শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা: নারীর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা এবং তাদের প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা বা হয়রানিকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা। এর অর্থ শুধু অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং এমন একটি সামাজিক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে নারী নির্ভয়ে বাঁচতে পারে।
* ব্যক্তিসত্তার প্রতি শ্রদ্ধা: একজন নারী একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা—এই সহজ সত্যটি মেনে নেওয়া। তার পছন্দ, অপছন্দ, স্বপ্ন, এবং জীবনযাপন পদ্ধতিকে সম্মান জানানো, যতক্ষণ না তা অন্যের ক্ষতি করছে।
* দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে না দেখে বা কেবল সৌন্দর্য দিয়ে বিচার না করে, তাদের মানবিক মূল্যবোধ ও অবদানকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের সমান অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা।
সমাজে নারীদের প্রতি অসম্মানের মৌলিক কারণসমূহ
নারীদের প্রতি অসম্মান প্রায়শই গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। এর কিছু মৌলিক কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
* পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা: যুগ যুগ ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সমাজে নারীর স্থানকে গৌণ করে রেখেছে। পুরুষকে শ্রেষ্ঠ এবং নারীকে পুরুষের অধীনস্থ ভাবার এই চিন্তাধারা নারীর প্রতি অসম্মানজনক আচরণকে বৈধতা দেয়।
* শিক্ষার অভাব ও কুসংস্কার: নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেওয়া বা সমাজে প্রচলিত নানা কুসংস্কার নারীর অধিকার ও মর্যাদা খর্ব করে। ধর্মীয় অপব্যাখ্যাও অনেক সময় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের জন্ম দেয়।
* অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা: অনেক ক্ষেত্রে নারী অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক দুর্বলতা নারীর অবস্থানকে দুর্বল করে দেয় এবং অসম্মানকে সহজ করে তোলে।
* গণমাধ্যম ও পপ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব: কিছু গণমাধ্যম এবং পপ সংস্কৃতি নারীকে কেবল পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে বা তাদের সম্পর্কে ভুল বার্তা ছড়ায়, যা সমাজে নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।
* আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি: নারীর প্রতি সহিংসতা বা অসম্মানজনক আচরণের ক্ষেত্রে আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে। এতে নারী তার অধিকার রক্ষায় ভরসা পায় না।
* পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব: অনেক পরিবারে শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই নারী-পুরুষের সমতা বা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দেওয়া হয় না, যা পরবর্তীতে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রভাবিত করে।
সম্মান প্রতিষ্ঠার পথ: ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত দায়বদ্ধতা
নারীদের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রতিষ্ঠা করা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা। কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নিচে তুলে ধরা হলো:
* ১. পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা: প্রতিটি পরিবারে ছেলে ও মেয়ে উভয়কেই ছোটবেলা থেকে সমান চোখে দেখা এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দেওয়া উচিত। ঘরের কাজে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।
* ২. শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন: পাঠ্যপুস্তকে নারী-পুরুষের সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং নারীর অবদানকে তুলে ধরা উচিত। শুধু সহশিক্ষা নয়, এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে শিক্ষার্থীরা লিঙ্গবৈষম্যহীন মন নিয়ে বেড়ে উঠতে পারবে।
* ৩. গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা: গণমাধ্যম এবং বিনোদন শিল্পকে নারীর সঠিক ও মর্যাদাপূর্ণ চিত্র তুলে ধরতে হবে। নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা বা অবমাননাকর চিত্রায়ন থেকে বিরত থাকতে হবে।
* ৪. আইনের কঠোর প্রয়োগ: নারীর প্রতি সহিংসতা বা অসম্মানজনক আচরণের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অপরাধ প্রবণতা কমাতে সাহায্য করবে।
* ৫. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সহায়তা করা উচিত। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে তাদের আত্মনির্ভরশীলতা বাড়ানো গেলে সমাজে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
* ৬. দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিকতার পরিবর্তন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই উচিত নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের বৈষম্যমূলক বা অসম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা। নারীকে তাদের যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা।
* ৭. সচেতনতামূলক প্রচারণা: সমাজের সকল স্তরে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব নিয়ে ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো যেতে পারে। বিভিন্ন ক্যাম্পেইন, আলোচনা সভা এবং কর্মশালার আয়োজন করে মানুষকে এই বিষয়ে সংবেদনশীল করে তোলা।
* ৮. পুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ: নারীর প্রতি সম্মান প্রতিষ্ঠায় পুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। পুরুষদের উচিত লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং নারীর অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো।
* ৯. রোল মডেল তৈরি: সমাজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সমতাপূর্ণ আচরণকারী পুরুষদের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে।
* ১০. নারীর প্রতি সহিংসতা দেখলে নীরব না থাকা: যেকোনো স্থানে নারীর প্রতি সহিংসতা বা অসম্মানজনক আচরণ দেখলে নীরব দর্শক না থেকে তার প্রতিবাদ করা উচিত।
উপসংহার
নারীর প্রতি সম্মান কেবল নারীর অধিকার নয়, এটি একটি সভ্য সমাজের ভিত্তি। আমাদের সমাজকে যদি সত্যিই উন্নত করতে হয়, তাহলে কেবল মুখে নারীবাদী স্লোগান দিলে চলবে না, বরং প্রতিদিনের আচরণে, চিন্তাভাবনায় এবং কর্মে নারীদের প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই পরিবর্তন একদিনে আসবে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি কর্মক্ষেত্র এবং প্রতিটি নাগরিককে তাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করতে হবে। যখন আমরা প্রতিটি নারীকে তার ব্যক্তিসত্তা, মেধা ও অধিকারের ভিত্তিতে সম্মান করতে শিখব, তখনই একটি শান্তিপূর্ণ, সমতাপূর্ণ এবং উন্নত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন