প্রতি ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার: জরুরি স্বাস্থ্যের এক নতুন দিগন্ত

ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ১০ জন অকথিত বাঙালি মহামানব:
১. হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) (১৮৩৩-১৮৯৬)
হরিনাথ মজুমদার, যিনি 'কাঙাল হরিনাথ' নামেই অধিক পরিচিত, ছিলেন নদীয়ার কুমারখালীর এক কিংবদন্তী। তিনি ছিলেন একজন অদম্য সাংবাদিক, সমাজ সংস্কারক এবং নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিপীড়িত কৃষকদের কণ্ঠস্বর। তাঁর প্রতিষ্ঠিত 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' (১৮৬৩ সাল) পত্রিকা ছিল বাংলার প্রথম গ্রামীণ সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম। এই পত্রিকাটি মূলত কৃষকদের অভাব-অভিযোগ, নীলকরদের বর্বরতা এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে তথ্য তুলে ধরত। তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের দুর্দশার কথা শুনতেন এবং তা পত্রিকায় প্রকাশ করতেন, যা সেসময়ের প্রভাবশালী নীলকরদের রোষানলে পড়েছিল। বহুবার তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তার প্রেস ভাঙচুর করা হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনো সত্য প্রকাশ থেকে পিছপা হননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বাল্যকালে কাঙাল হরিনাথকে 'গুরুদেব' সম্বোধন করতেন এবং তাঁর কাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি বহু গান ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন, যেখানে সমাজের অন্যায়-অবিচার এবং মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন। তার আত্মজীবনী 'কাঙালের জীবনকথা' বাংলা সাহিত্যের এক মূল্যবান সম্পদ।
২. সজনীকান্ত দাস (১৮৯৬-১৯৬২)
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সজনীকান্ত দাস একটি বিতর্কিত কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নাম। তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রাবন্ধিক, কবি, সম্পাদক এবং সাহিত্য সমালোচক। তার সম্পাদিত 'শনিবারের চিঠি' (১৯২৪ সাল) পত্রিকা ছিল বাংলা সাহিত্যের একটি প্রভাবশালী মুখপত্র, যা একদিকে যেমন নতুন লেখকদের লেখার সুযোগ দিত, তেমনি অন্যদিকে সাহিত্যিকদের মধ্যে সুস্থ সমালোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিত। সজনীকান্ত তার রসবোধ এবং তীক্ষ্ণ সমালোচনামূলক রচনার জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি তৎকালীন অনেক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের (যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম) রচনার সমালোচনা করেছেন, যা অনেক সময় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে, এর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে আরও পরিশীলিত করতে এবং নতুন সাহিত্যিকদের বিকাশে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে তার প্রভাব অনস্বীকার্য।
৩. মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩)
নদীয়ার এই মহারাজা কেবল একজন শাসক ছিলেন না, ছিলেন শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক বিশাল পৃষ্ঠপোষক। তার সভাতেই ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর (যিনি 'অন্নদামঙ্গল' কাব্য রচনা করেন) এবং রামপ্রসাদ সেন (বিখ্যাত শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতা) এর মতো দিকপাল কবিরা আশ্রয় পেয়েছিলেন এবং তাদের অমর সৃষ্টিগুলো তারই পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে নবদ্বীপ ছিল টোল ও সংস্কৃতচর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, যা বাংলার জ্ঞানচর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিল। তিনি নিজেও একজন বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন এবং বিভিন্ন শাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়েও তিনি বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে এবং বিকশিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
৪. কিশোরীমোহন মন্ডল (১৮৫৭-১৯৪১)
কিশোরীমোহন মন্ডল ছিলেন বাংলার গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ এক অখ্যাত শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলার প্রত্যন্ত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আজীবন কাজ করেছেন। বহু গ্রামে তিনি নিজ উদ্যোগে বা স্থানীয়দের সহায়তায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা সেসময়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছেলে-মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি করেছিল। তিনি কেবল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হননি, বরং গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়তা করেছেন। তার মতো অসংখ্য নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক বাংলার শিক্ষার প্রসারে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন, যাদের নাম সাধারণত ইতিহাসে বড় করে লেখা হয় না, কিন্তু তাদের দেখানো পথেই আধুনিক বাংলার শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে উঠেছে।
৫. গদাধর দাস (অষ্টাদশ শতক)
গদাধর দাস ছিলেন শ্রীহট্টের (বর্তমান সিলেট, বাংলাদেশ) একজন প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনি মূলত 'সিদ্ধান্ত-লহরী' নামক জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনার জন্য পরিচিত। এই গ্রন্থটি তৎকালীন সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং জ্যোতির্বিদ্যা ও পঞ্জিকা গণনার ক্ষেত্রে এটি একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো। মধ্যযুগের বাংলায় যখন আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা তেমনভাবে বিকশিত হয়নি, তখন গদাধর দাসের মতো পণ্ডিতেরা তাদের মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করেছিলেন। তার কাজটি বাঙালি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।
৬. নগেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৬৭-১৯৬২)
নগেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক। তিনি বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন মন্দির, মঠ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের উপর ব্যাপক গবেষণা করেছিলেন। তার অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাংলার অজানা অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্যিক স্থানের তথ্য বেরিয়ে আসে। তিনি পুঁথি-পুস্তক, শিলালিপি এবং স্থাপত্যের নিদর্শন বিশ্লেষণ করে বাংলার গৌরবময় অতীতকে পুনর্গঠনে সহায়তা করেছেন। তার কাজ প্রত্নতত্ত্বপ্রেমী এবং ঐতিহাসিকদের জন্য মূল্যবান উপাদান সরবরাহ করেছে। তার নিরলস গবেষণা বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে আলোতে এনেছে।
৭. আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯-১৯৯৫)
আশাপূর্ণা দেবী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী লেখিকা, যিনি তার সাহিত্যকর্মে মূলত বাঙালি নারীর জীবন, সংগ্রাম এবং পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন। তিনি তার লেখার মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থান, তাদের অধিকার এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে চিত্রিত করেছেন। তার বিপুল পরিমাণ সাহিত্যকর্মের মধ্যে 'প্রথম প্রতিশ্রুতি', 'সুবর্ণলতা', 'বকুলকথা'—এই ত্রয়ী উপন্যাস বিশেষ উল্লেখযোগ্য, যা বাঙালি নারীর তিন প্রজন্মের জীবনের গল্প তুলে ধরে। তিনি সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (প্রথম নারী হিসেবে) সহ বহু পুরস্কার পেলেও, তার লেখার গভীরতা এবং সমাজের প্রতি তার বার্তা অনেক সময় মূলধারার সাহিত্য আলোচনায় যথাযথ মূল্যায়ন পায়নি। তার লেখায় উঠে এসেছে বাংলার সাধারণ নারীর অজানা আত্মত্যাগ ও অবদান।
৮. শরৎচন্দ্র পন্ডিত (দাদাঠাকুর) (১৮৭৯-১৯৬৮)
শরৎচন্দ্র পন্ডিত, যিনি 'দাদাঠাকুর' নামেই অধিক পরিচিত, ছিলেন বাংলার এক অসাধারণ গ্রাম্য কবি, ছড়াকার এবং রসিক মানুষ। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী, যিনি কোনো প্রথাগত উচ্চশিক্ষা ছাড়াই স্বীয় মেধা ও লোকজ্ঞান দিয়ে কাব্য রচনা করেছেন। তার 'বিবিধ সংগ্রহ' বা 'দাদাঠাকুরের কথা' আজও হাস্যরস, শ্লেষ এবং গভীর লোকশিক্ষার এক দারুণ উৎস। সমাজের নানা অসঙ্গতি, কুসংস্কার এবং দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে তিনি তার ছড়া ও কবিতার মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ সরলভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলার লোকসাহিত্যে তার অবদান অনস্বীকার্য।
৯. গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৪-১৯১২)
গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন আধুনিক বাংলা থিয়েটারের এক স্তম্ভ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন কিংবদন্তী অভিনেতা, নাট্যকার, পরিচালক এবং থিয়েটার ব্যক্তিত্ব। তার হাতেই আধুনিক বাংলা পেশাদার থিয়েটারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। তিনি প্রায় ৮০টিরও বেশি নাটক রচনা করেছেন এবং অসংখ্য নাটকে অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন। তার নাটকগুলোতে সামাজিক সমস্যা, পৌরাণিক কাহিনী এবং ঐতিহাসিক ঘটনা জীবন্ত হয়ে উঠত। তিনি থিয়েটারকে শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে সমাজ সংস্কার ও জনশিক্ষার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাংলা নাটকের ইতিহাসে তার অবদান অপরিহার্য।
১০. রামমোহন মল্লিক (অষ্টাদশ শতক)
রামমোহন মল্লিক ছিলেন অষ্টাদশ শতকের বাংলার একজন প্রভাবশালী এবং জনহিতৈষী ব্যবসায়ী। তিনি কেবল প্রচুর সম্পদ অর্জন করেননি, বরং সেই সম্পদ সমাজের উন্নয়নে উদারভাবে ব্যয় করেছিলেন। তিনি বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, চিকিৎসালয় নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন এবং পানীয় জলের উৎস (যেমন পুকুর বা কূপ) তৈরি করেছিলেন, যা স্থানীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তার মতো স্থানীয় বিত্তশালী ব্যক্তিরা নীরবে সমাজের ভিত্তি মজবুত করেছিলেন এবং শিক্ষাপ্রসার ও জনস্বাস্থ্যে বড় অবদান রেখেছিলেন।
উপসংহার
ইতিহাস কেবল ক্ষমতাধরদের গল্প বলে, কিন্তু মানবজাতির প্রকৃত অগ্রগতি ও সভ্যতার নির্মাণে এই মহামানবদের অবদান অবিস্মরণীয়। তারা সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছেন, জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছেন, জীবন বাঁচিয়েছেন এবং সংস্কৃতির চাকা সচল রেখেছেন। তাদের গল্পগুলো হয়তো পুঁথিতে নেই, নেই বড় বড় ফলকে খোদাই করা। কিন্তু তাদের কর্মফল বাংলার মাটি ও মানুষের সাথে মিশে আছে। তাদের স্মরণ করা এবং তাদের অবদানের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আমাদের দায়িত্ব। কারণ, প্রকৃত ইতিহাস কেবল রাজাদের নয়, সাধারণ মানুষের অসামান্য জীবনও ধারণ করে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মন্তব্য লিখুন